আব্দুল্লাহ আল মোমিন (শিশির)
দৈনিক ৭১ সংবাদ
২৫শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
বাংলাদেশের ৪৪টি জেলার মধ্যে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম রেলপথ। প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী এই পথে চলাচল করলেও এখন পর্যন্ত রেলের ঘাটতি ১০০ কোটি টাকা। যেখানে যাত্রী সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে সেখানে লাভ করার কথা থাকলেও প্রতিনিয়ত লোকসান দিয়ে যাচ্ছে জন-গুরুত্বপূর্ণ এই পরিবহন খাতটি। ডিজিটাল বাংলাদেশে মানুষ যেখানে ঘরে বসেই নিতে পারছেন সরকারি বহু সেবা। সেখানে ব্যতিক্রম যেন বাংলাদেশ রেলওয়ে! সম্প্রতি তাদের টিকিট কাটার পদ্ধতি আরও জটিল করে বুঝিয়ে দিয়েছে, সংস্থাটি যেন হাঁটছে পুরো উল্টো পথে!
রেলভবনে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে রেলমন্ত্রী টিকিট কালোবাজারির হাত থেকে ট্রেন যাত্রীদের মুক্ত করতে বেশ কিছু নতুন উদ্যোগ নেয়ার কথা জানান তিনি। এর মধ্যে অন্যতম টিকিট কাটার পদ্ধতি। মন্ত্রী বলেন এখন ‘টিকিট যার, ভ্রমণ তার’ এ-ই স্লোগানে নতুন নিয়ম করা হচ্ছে আগামী ১ মার্চ থেকে।
নতুন নিয়মে আগে থেকে যাদের নিবন্ধন করা আছে, তাদের ওয়েবসাইটে গিয়ে সাইন ইন করতে হবে। এরপর জন্ম নিবন্ধন সনদ আপলোড করে নতুন করে নিবন্ধন করতে হবে। আর যাদের আগে থেকে নিবন্ধন করা নেই, তাদের প্রথমে ওয়েবসাইটে সাইন আপ করতে হবে। এরপর জাতীয় পরিচয়পত্র আপলোড করে পুনরায় নিবন্ধন করতে হবে। ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সীরা বাবা/মা এর জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা নিজের জন্ম নিবন্ধন সনদ দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। এ ছাড়া চাইলে মোবাইল নম্বর থেকে খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠিয়েও নিবন্ধন করা যাবে। প্রক্রিয়ার এখানেই শেষ নয়, এ নিবন্ধনের জন্য সাইন আপ করতে একটি ই-মেইল আইডি লাগবে। অর্থাৎ, যারা ট্রেনে ভ্রমণ করবেন তাদের ই-মেইল এবং ইন্টারনেট সম্পর্কে অন্তত কিছুটা জানাশোনা থাকতে হবে। স্মার্টফোন বা কম্পিউটার চালনা জানতে হবে। আর কাউন্টার থেকে টিকিট কাটলেও আগে থেকে নিবন্ধন থাকতে হবে। এই প্রক্রিয়া শেষ হলেই কেবল অনলাইনে, অ্যাপে কিংবা কাউন্টার থেকে টিকিট কাটা যাবে।
ট্রেনের যাত্রী ও মালামালের সার্বিক নিরাপত্তা এবং ভালো-মন্দ দেখার জন্য আছে রেলওয়ে পুলিশ। ঈদ, পুজোয় চাপ বাড়লে র্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও যুক্ত হয়। রয়েছে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী। এরপরও ট্রেনের টিকিট এর রাজ্বত্ব কালোবাজারিদের দখলে। নতুন এ-ই ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হচ্ছে টিকিট কালোবাজারি বন্ধ। সাম্প্রতিক সময় ‘জো বাইডেন’ ও ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প’সহ বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামে নিবন্ধন করে টিকিট কাটা হয়েছে বলে রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এতে রেলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। নতুন এই ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা হলে টিকিট কালোবাজারি রোধ করা যাবে বলেন রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রেল কর্তৃপক্ষ একটি মোবাইলে একটি এনআইডি নিবন্ধন এবং শতভাগ অনলাইন সেবা দেয়ার জন্য আদৌ প্রস্তুত আছে কিনা সেটা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
তবে টিকিট কালোবাজারি বন্ধ হোক বা না হোক রেলওয়ের এ-ই সিদ্ধান্তে অনেক যাত্রীই হারাবেন ট্রেনে চড়ার অধিকার বাড়বে যাত্রীদের হয়রানি ও কষ্ট।
বাংলাদেশে একটি বড় জনগোষ্ঠী যেখানে প্রযুক্তির সুবিধার বাইরে, দেশের যে নাগরিকের ইন্টারনেট সম্পর্কে তেমন কোন জ্ঞান নেই বা যে ব্যক্তি ই-মেইল কি সে সম্পর্কেই কোন ধারণা নেই তারা কীভাবে নিবন্ধন করবেন সেটা এখন এক বিশাল প্রশ্ন। প্রত্যন্ত কোনো গ্রামের মানুষ যিনি জীবনে কোনো দিন ট্রেনে চড়েননি তাঁর কোনো মোবাইল নম্বর নেই কিংবা ইমেইল আইডি নেই জরুরি কাজে ঢাকায় এসে তাঁর চট্টগ্রামে যাওয়ার প্রয়োজন হলো। তিনি কীভাবে টিকিট কাটবেন, এর কোনো সমাধান নেই নতুন নিয়মে, বা কারও জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকলে কিংবা হারিয়ে গেলে ওই ব্যক্তির পক্ষে টিকিট কেটে ট্রেনে যাতায়াতের সুযোগ থাকবে না। আবার কেউ অন্যের জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দিয়ে টিকিট কাটলে সেটিকে বেআইনি হিসেবে গণ্য করবে রেলওয়ে। এ ক্ষেত্রে তাঁকে জরিমানা করতে পারবে রেলওয়ে। তাহলে তারা কীভাবে ট্রেনে ভ্রমণ করবে? অথচ আইন অনুযায়ী তো দেশের সব নাগরিকের ট্রেনে ভ্রমণের অধিকার রয়েছে।
বর্তমানে রেলের অর্ধেক টিকিট অনলাইন ও অ্যাপে বিক্রি করা হয়। বাকি অর্ধেক কাউন্টার থেকে। যদিও রেলের সব টিকিট অনলাইনে বিক্রির প্রক্রিয়া চলছে। ফলে কারো কাছে স্মার্ট ফোন বা মোবাইল না থাকলে তিনি ট্রেনে ভ্রমণ করতে পারবেন না। আবার জরুরি প্রয়োজনে কেউ ট্রেনে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে চাইলেও থাকবে না সে সুযোগ। বাংলাদেশে এখনও নিবন্ধন কাজ, ফর্ম ফিল-আপ বা পাসপোর্ট, ভিসার কাজে এক শ্রেণীর মানুষ টাকার বিনিমেয়ে পাড়ার দোকানের সাহায্য নিয়ে থাকেন সেখানে এখন ট্রেনের টিকেট কাটতেও দোকানের সাহায্য নিতে হয় কিনা সেটা এখন দেখার বিষয়। ট্রেন ভ্রমণ কী শুধু মোবাইল এবং স্মার্ট ফোনের গ্রাহকদের জন্য? রেলওেয়ের এমন সিদ্ধান্ত কি তাহলে মোবাইল কোম্পানি গুলোকে লাভবান করার উদ্দেশে?
ইউরোপে অনলাইনে, বিভিন্ন অ্যাপে এবং কাউন্টারে টিকিট কাটা যায়। সেখানে কাউকে ব্যক্তিগত কোনো তথ্য দিতে হয় না। বিশেষ করে কাউন্টারে কিংবা ভেন্ডিং মেশিন থেকে টিকিট কাটার ক্ষেত্রে শুধু দাম পরিশোধ করলেই চলে। ইউরোপের দেশগুলোতে যেখানে শিক্ষিতের হার বেশি, প্রযুক্তিও উন্নত কিন্তু তাঁদের টিকিট কাটার ক্ষেত্রে এত জটিলতা নেই।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিকে তাকালে সেখানে দেখা যায়, রেলস্টেশনের আশপাশের নির্ধারিত দোকান থেকেও টিকিট কেনা যায়। এছাড়া অনলাইন সুবিধা তো আছেই। তারা আমাদের থেকে উন্নত দেশ, অথচ টিকিট কাটার ক্ষেত্রে তারা পদ্ধতি জটিল না করে সহজ করেছে। আর বাংলাদেশ দিন দিন সহজ থেকে করছে জটিল।
সহজ-সিনেসিস-ভিনসেন (যৌথ) বেসরকারি এ-ই প্রতিষ্ঠান গুলো রেলের টিকিট বিক্রির দায়িত্বে থাকবে। জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে নিবন্ধনের প্রক্রিয়াটি প্রথমে তারা তথ্য নিয়ে রেলওয়ের ওয়েবসাইটে জমা করবে। সেখান থেকে নির্বাচন কমিশনের তথ্যভান্ডার দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের সঠিকতা যাচাই করা হবে। এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে রেলের একটি চুক্তি হয়েছে। এর বিনিময়ে নির্বাচন কমিশনকে প্রতি বছর পাঁচ লাখ টাকা দেবে রেলওয়ে। টিকিট বিক্রির চুক্তির অংশ হিসেবে সহজ-সিনেসিস-ভিনসেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রেলওয়েকে পয়েন্ট অব সেলস (পিওএস) মেশিন বা পজ মেশিন দেবে। এই মেশিন নিয়ে টিকিটে যাত্রীর নাম ও সনদ মিল আছে কিনা তা পরীক্ষা করবেন রেলের কর্মকর্তারা। দীর্ঘদিন ধরে ট্রেন টিকিট পরীক্ষক (টিটিই) এর বিরুদ্ধে টিকিট ছাড়া যাত্রীদের কাছ থেকে অবৈধ ভাবে টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ আছে। এবার কেউ অন্যর জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে টিকিট কেটে ভ্রমণ করলে টিটি কে ঘুষ দিয়ে ছাড়া পেতে হবে এর ফলে টিটির জন্য আরেকটি ঘুষ নেওয়ার উৎস তৈরি হলো কি? সেটা কিন্তু একটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এর মধ্যেই ডিজিটাল সিস্টেমটি নিয়েও অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। রেলওয়ের ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনে রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে তথ্যের ইনপুট নিচ্ছে না বলে কয়েকজন গ্রাহক বাংলাদেশ রেলওয়ের ফেইসবুক পেইজে ছবি সহ অভিযোগ করেছেন।
এ-ই বিষয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের উদ্দর্তন এক কমর্কতা বলেন, আমরা মাত্র শুরু করতে যাচ্ছি। ভুল ত্রুটি হতেই পারে। সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা সিস্টেমটা ডেভেলপ করবো। সমস্যা যে নেই বলবো না। কিন্তু সেটা তো রাতারাতি ঠিক হবে না। সময় লাগবে। মূল বিষয় হল আজ হোক কাল হোক ধীরে ধীরে আমাদের এনালগ সিস্টেম থেকে বের হয়ে আসতেই হবে। দেশের বিভাগীয় শহরের রেল স্টেশন ও আন্তঃনগর ট্রেনের প্রারম্ভিক স্টেশনসমূহে সর্বসাধারণের নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করার জন্য একটি করে হেল্প ডেস্ক স্থাপন করা হবে।
এত কিছুর পরও টিকিট কালোবাজারি বন্ধ করতে না পারলে এ-ই ব্যার্থতার দায় কে নিবে সরকার নাকি রেল মন্ত্রণালয়? সরর্ষের ভিতরের ভুতকে নিমূল না করে যাত্রীদের টিকিট কাটার পদ্ধতি জটিল ও কঠিন করার পেছনে রেলওয়ে কোনো গোষ্ঠীকে লাভবান করছে কিনা তা সময়ে বলে দিবে।